নিরাশ প্রাণে আশার আলো

প্রায় মুসলমান আজ হতাশ। ব্যর্থ- পরাজিত মনোভাবে আক্রান্ত। কী অর্থনীতি, কী রাজনীতি, কী প্রতিপত্তি আর শক্তিমত্তা সার্বিক দিকেই মুসলিম জাতি পতিত। প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিজাতিদের আধিপত্য। পরাশক্তিধর অমুসলিম বিশ্বের তুলনায় মুসলিমবিশ্ব যেন যুগ যুগ পিছিয়ে। পেছানোর পেছনে যথেষ্ট কারণও আছে। এক এক করে কারণগুলোই বলা যাক আগে।

নিরাশার কারণঃ
এক. প্রিয়নবীর আদর্শ থেকে সরে যাওয়া:
সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ প্রিয়নবীর আদর্শ। রব তায়ালা ইরশাদ করেন,
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ
প্রকৃতপক্ষে তোমাদের জন্যে আল্লাহ্‌র রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম)-এঁর সত্তায় রয়েছে অতি উত্তম (জীবন) আদর্শ।
(সূরা আহযাব:২১)

এই আদর্শ কেবল পরকালীন মুক্তিরই মাধ্যম নয় বরং ইহকালীন সাফল্যেরও নিয়ামক। এই আদর্শই যে বদর প্রান্তরে তিনশত তের জনকে বিজয়ী বানিয়েছিলো হাজার জনের উপর। উহুদে মাত্র ৭০০ জনকে তিন সহস্রের উপর।
হুনায়নে ১২ হাজার জনকে ৪০ হাজার জনের উপরে৷ এই আদর্শই তো অর্ধবিশ্বের শাসনক্ষমতা এনে দিয়েছিলো মুসলমানদের হাতে। বানিয়েছিলো বিশ্বের পরাশক্তিধর। কিন্তু যেই না মহানবীর সুমহান আদর্শ থেকে মুসলিম জাতির বিচ্যূতি শুরু হলো, পেছাতে লাগলো মুসলিমবিশ্ব।

দুই. সঠিক নেতৃত্বহীন জাতি মাঝিহীন নৌকার মতো। সঠিক নেতৃত্বই পারে কোনো জাতিকে গহীন অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসতে। মুসলিমবিশ্ব আজ নিদারুণভাবে যোগ্য নেতৃত্বশূন্য। মুসলিম দেশগুলোর নেতাদের প্রায় সবাই-ই আজ জালিম পরাশক্তির প্রতি ভীত, শঙ্কিত। ফলে নতচিত্ত চাটুকারিতার নির্লজ্জ, ঘৃণ্য পথটাই তারা বেছে নিয়েছেন। ক্ষুদ্র লেখক যখন লেখাটি লিখছেন(২৫.০৫.২০২৫), তার কয়েকদিন আগেও স্বয়ং আরবেই উষ্ণ সংবর্ধনা পেয়েছেন পরাশক্তিধর বিজাতি রাষ্ট্রের এক কুখ্যাত জালিম শাসক। যার হাতে মজলুম ফিলিস্তিনি মুসলিমদের রক্ত লেগে আছে। অথচ আরব রাষ্ট্রগুলোর নেতারা এদেরই দ্বারে সবিনীত। নত তোষামুদে।

তিন. মুনাফিকদের চক্রান্ত:
ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য কাফির-মুশরিকরা যত না ক্ষতিকর হতে পারে, মুনাফিকরা তারচে শতগুণ বেশি। এজন্যই বোধহয় জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে কাফির-মুশরিকদের অবস্থান না দিয়েচা মুনাফিকদের দেয়া হয়েছে।
রব তায়ালার ইরশাদ,
إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ
নিশ্চয় মুনাফিকদের স্থান জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে।
(সূরা নিসা:১৪৫)

মুসলিম নাম আর লেবাসধারী মুনাফিকরা যুগে যুগেই ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতিতে লিপ্ত। কিভাবে মুসলমানদের ঈমানী শক্তি লুপ্ত করা যায়, কাফির-মুশরিকদের ভয় জাগিয়ে অন্তরকে ভীত-শঙ্কিত করা যায়, সত্যিকারের জিহাদের প্রতি সাধারণদেরকে বীতশ্রদ্ধ করা যায়, পরকালের উপর পার্থিবতাকে প্রাধান্য দেয়ানো যায়- এহেন চেষ্টাই তাদের ব্রত।

চার. পারস্পরিক দ্বন্ধ-কলহ ও অনৈক্য:
মৌলিক-অমৌলিক(উসূলী, ফুরুয়ী) বিভিন্ন বিষয়ে মতভেদ মুসলিম উম্মাহকে দলে দলে বিভক্ত করে রেখেছে। ফুরুয়ী মতভেদ যেখানে উম্মাহর বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হবার কথা ছিলো অনেকক্ষেত্রে সেখানেও অজ্ঞতা আর গোঁড়ামিবশতঃ অনৈক্যের মাধ্যম বানিয়ে রাখা হয়েছে।
মুসলিমবিশ্বে অনৈক্যের মূলে মূলতঃ দুটি গ্রুপের ভূমিকা প্রধান। শিয়া(রাফেযী) ও খারেজি। অধুনাকালে খারেজি হিসেবে স্বীকৃত ওহাবীইজমের(মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাব নজদীর বিশেষ মতাদর্শ) তথাকথিত শিরক-বিদআত ফোবিয়া সর্বাধিক হারে মুসলমানদের মাঝে দ্বন্ধ-কলহ আর অনৈক্যের বীজ ছড়িয়ে যাচ্ছে। যত্রতত্র তথাকথিত এই শিরক-বিদআত ফোবিয়া ছড়িয়ে মুসলমানদের ঈমানের রূহ তাজীমে রসূলকে নির্বাপিতপ্রায় করা হচ্ছে। ফলে মুসলমানদের ঈমানী শক্তি দুর্বল থেকে দিনদিন আরও দুর্বলতর হচ্ছে। যার অনিবার্য ফল মুসলিমবিশ্বের হতাশা।

পাঁচ. আঁতাতকারী গোষ্ঠীর কবলে নাভিঃ জাযিরাতুল আরবের ক্ষমতা মূলতঃ পশ্চিমাদের সাথে আঁতাতকারী গোষ্ঠীর (ওহাবীদের) হাতে। এটিও মুসলিমবিশ্বের দুর্বলতার অন্যতম কারণ। কারণ জাযিরাতুল আরব হচ্ছে, মুসলমানদের নাভি। নাভিই যখন ওপেন সিক্রেটভাবে বিজাতিদের অধীন, গোটা দেহে তখন হতাশা আসবে না তো কী!

ছয়. অর্থনৈতিক পরাজয়ঃ
বৈশ্বিক অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ আজ বিজাতিদের হাতে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশ্বব্যাংক, IMF ইত্যাদির হাতেই তো অর্থনীতির নাটাই। মুসলিম জাতি এদের সুতোয় বাঁধা। এহেন অর্থনৈতিক পরাধীনতাও হতাশার অন্যতম বড় কারণ।

সাত. প্রাচ্যবিদদের অপতৎপরতাঃ
ইসলাম ও এর নানাবিধ শাস্ত্রের গবেষণা কেবল মুসলিমরাই করে না বরং ইসলামবিরোধীরাও করে। এর অন্যতম উদাহরণ প্রাচ্যবিদগণ(Orientalists)। কিন্তু এদের উদ্দেশ্য ভিন্ন। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়কে বিকৃত করে মুসলমানদের মাঝে ছড়িয়ে এরা বিভ্রান্তি ও অনৈক্যের বিষবাষ্প ছড়ায়। এটিও চলমান হতাশার এক মোটা কারণ।

আট. পাশ্চাত্যবাদীদের অপকৌশলঃ
প্রাচ্যবিদদের পাশাপাশি পাশ্চাত্যবাদীরাও ইসলামের বিরুদ্ধে কম যায় না। বরং এদেরও অপকৌশল চলছে সমানতালে। পশ্চিমা সংস্কৃতিকে এরা এমনভাবে প্রচার করে যে, সাধারণ মুসলিমরা বিভ্রান্ত হয়। মননে এক প্রকার পাশ্চাত্য মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে। তাদের মনে হতে শুরু হয় যে, ইসলাম সেকেলে। পশ্চিমাদের অনুকরনই স্মার্টনেস, আধুনিকতা। তাদের অনুসরণেই জাগতিক উন্নতি। যার ফলে ইসলাম থেকে ক্রমশঃ দুরত্ব তৈরি হয়। বাড়ে হতাশা।

নয়. পাশ্চাত্য প্রভাবিত মিডিয়ার কারসাজিঃ
আন্তর্জাতিক ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়ামহল অনবরত ইসলামোফোবিয়া ছড়াচ্ছে। তাদের কারসাজির জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে, কোনো অপরাধীর ধর্মীয় পরিচয় মুসলিম হলে তারা তখন মুসলিম পরিচয়কে হাইলাইট করে। সেইম অপরাধী বিজাতি হলে তখন আর ধর্মীয় পরিচয়কে হাইলাইট করে না। তখন জাস্ট নামটিই উল্লেখ করে। অপরদিকে কোনো কৃতিত্বপূর্ণ কাজে এর বিপরীত করে। তখন মুসলিমদের ধর্মীয় পরিচয় হাইলাইট করে না। জাস্ট নামটাই বলে। আর বিজাতি হলে তখন তার ধর্মীয় পরিচয়কেই হাইলাইট করে। এভাবেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছে পাশ্চাত্যবাদী মিডিয়াগুলো।

দশ. ইতিহাস বিকৃতিঃ
ইসলামোফোবিয়ার প্রসারকারীরা এক্ষেত্রে বিরাট প্রহসনমূলক কাজ করে। মুসলমানদের ইতিহাসের কিছু বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা ও রাজনৈতিক কোন্দলের দিকটাকে অতি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরে। এর বাইরে যে বিরাট ইতিহাস রয়েছে তা তারা যারপরনাই উপেক্ষা করে৷ মুসলমানদের নৈতিক, অর্থনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যকেন্দ্রিক যে বিরাট কৃতিত্বপূর্ণ অনবদ্য ইতিহাস, তা তারা বেমালুম ভুলে থাকে।

এগারো. ইহুদী-নাসারাদের তৈরি মুসলিম সংগঠনঃ
বোদ্ধা মাত্রই বুঝেন যে, আইএসের মতো বিভিন্ন ইসলামিক জঙ্গি সংগঠন মূলতঃ ইহুদি-খ্রিস্টানদের তৈরি। এগুলো ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের চক্রান্তের অংশ। এসব সংগঠনের মাধ্যমে ইসলামের নামে উগ্রতা, সন্ত্রাস ঘটিয়ে ইসলামের নামে অপবাদ রটায় যে, ইসলাম একটি উগ্রবাদী সন্ত্রাসী ধর্ম। নাউজুবিল্লাহ। অথচ ইসলামের সাথে ওসব দলের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ন্যূনতম সম্পর্ক নেই।

বারো. গত শতকে বিজাতিদের কাছে মুসলমানদের হারঃ
গত শতকে পরাজয়ের সূচনা মূলতঃ ইসলামি খিলাফত তথা উসমানি খিলাফতের পতনের মাধ্যমে। তাদের বিরুদ্ধে ওয়াহাবিদের ষড়যন্ত্র আর ব্রিটিশদেরকে সহায়তার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯২৪ সালে প্রায় ৭০০ বছরের এই খিলাফতের সূর্য একেবারে অস্তমিত হয়। ইসলামি বিশাল সাম্রাজ্য ভেঙে যায়। ভেঙে খান খান হয়। পরিণত হয় এখানে সেখানে টুকরো টুকরো দেশে। এরপরে ইতিহাসও সুখকর নয়। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের পতন ঘটে। ফিলিস্তিনের বুকে ব্রিটিশদের মাধ্যমে জোরপূর্বক প্রতিষ্ঠিত হয় কুখ্যাত, দানবীয়, সন্ত্রাসী ইহুদি-রাষ্ট্র ইসরাইল। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে মিশর-ইসরাইল যুদ্ধে মিশর হারে। ১৯৬৭ এর ৫-১০ জুন ছয়দিনের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে আরবরা পরাজিত হয়। ১৯৭৩ এর অক্টোবরে আবারও আরব-ইসরাইল যুদ্ধ হয়। এতেও আরব হারে৷
এভাবে গতশতকে এসকল পরাজয়ের প্রেক্ষিতে মুসলিমবিশ্ব হতোদ্যম হয়। হয় হতাশাগ্রস্ত।

এছাড়াও মুসলিমদের দেশে দেশে আজ বিজাতিদের অত্যাচারের খড়গ। কেবল মুসলিম হবার কারণে মানবতার চরম অবমাননার শিকার তারা।

এভাবে মুসলিমবিশ্বের আজকের হতাশার নানাবিধ কারণ রয়েছে। সবগুলো কারণ একত্র হয়ে মুসলমানদেরকে হতাশার ঘোর অমানিশায় আচ্ছন্ন করেছে।

নিরাশ প্রাণে আশার আলোঃ
***
মুসলিমবিশ্বের এই দুর্দিনে, চরম দুর্দিনে পরতে পরতে নিকষ কালো আঁধার৷ যতদূর দৃষ্টি যায় কেবলি আঁধার। আঁধার আর আঁধার। তবু আশাহীনতার কারণ নেই। কারণ মুসলিমদের নিরাশ প্রাণে আশার আলো জ্বালানোর মতো যথেষ্ট অনুষঙ্গ আছে।

মাসুম বিল্লা (সহকারী শিক্ষক), ফেনী সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়।

 

Share

Add Your Comments

Your email address will not be published. Required fields are marked *